কনটেন্টটি শেয়ার করতে ক্লিক করুন
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা
স্থানীয় সরকার বলতে কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সেই এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসনকে বুঝায় যা কেন্দ্রীয় সরকারেরই একটি সমপ্রসারিত অংশ৷ যেমন - পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম ও এদের সাথে সংযুক্ত অন্যান্য সংস্থার কার্যকলাপ ও রীতিনীতিকে বোঝায়৷ এ সমস্ত সংস্থা কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা স্থানের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে৷ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কল্যাণের জন্য নানারকম সেবামূলক কাজের পরিকল্পনা ও পরিচালনা করার এক মাধ্যম বিশেষ৷ এই সংস্থার পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত বা মনোনীত হয়ে থাকে৷ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ওপর থেকে ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যকে একটি সুনির্দিষ্ট চ্যানেলের মাধ্যমে নিম্নতর পর্যায়ে ক্রমে হস্তান্তর করা হয়৷ এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রতিটি স্তর একে অপরের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকে এবং এদের সকলের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকে৷
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা
গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক৷ বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ৷ গ্রামের উন্নয়ন ভিন্ন বাংলাদেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়৷ আর এই উন্নয়ন কেন্দ্রীয়ভাবে শুধুমাত্র সরকারের পক্ষে অসম্ভব৷ এ কারণে বাংলাদেশের সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গঠন করা হয়েছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা৷ যার দ্বারা তৃণমূল পর্যায়ের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে৷ যে সকল কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রয়োজন:
১. গ্রামীণ এলাকার প্রতি সরকারের দৃষ্টি দান: স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রামীন জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে দৃষ্টি দান৷ যেমন, কৃষি উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থাপন ইত্যাদি৷
২. দ্রুত ও সহজ বিচার ব্যবস্থা: বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দেবার জন্য উপজেলা পর্যায়ে ফৌজদারী কোর্ট স্থাপন করা, ছোট-খাট অপরাধের বিচারের জন্য সালিসীর ব্যবস্থা করা যাতে গ্রামীন জনগণ সহজেই আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে, তাদের শহরমুখী হতে না হয়৷
৩. গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন: সামাজিক সমস্যা নিরসন যাতে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ সুগম হয়৷ পল্লী এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, সরকারি অফিসের শাখা সম্প্রসারণ, বিভিন্ন উন্নয়ন নীতি নির্ধারণ, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে৷ রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি যাতে গ্রামীণ নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ থাকে৷
শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তৃণমূল পর্যায়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে৷ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চা এবং সকল কার্যক্রমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে সাহায্য করে৷ জণগণের সাথে সরকারের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গঠন করা হয়েছে৷
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গঠন প্রকৃতি
জনগণের প্রয়োজন ও আশা আকাঙ্ক্ষার ধারক ও বাহক হিসাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কাজ করে আসছে৷ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুই ধরনের (এক) শহর বা পৌর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এবং (দুই) গ্রাম স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা৷ শহর বা পৌর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুই ধরনের: পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন এবং গ্রাম স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চার ধরনের: গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ৷ নিচে একটি ছকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গঠন দেখানো হলো:
![]() |
তথ্যসূত্র: স্বশাসিত ইউনিয়ন পরিষদ এডভোকেসি গ্রুপ - বাংলাদেশ এর জাতীয় সম্মেলন ২০০৫ উপলক্ষে বিশেষ প্রকাশনা - স্বশাসন, কারেন্ট এফেয়ার্স (সাধারণ জ্ঞান) বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী - ২০০৪৷
বাংলাদেশের সংবিধানে তৃনমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য স্থানীয় সরকারকে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান এবং একই সাথে জনগণের অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশের সংবিধানে স্থানীয় সরকার সম্পর্কে ৪টি অনুচ্ছেদ রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৯, ১১, ৫৯ এবং ৬০)৷ এসব অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা ও কার্যকারিতা বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে৷
সংবিধানের ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, "রাষ্ট্র সংশিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে উত্সাহ দান করবেন এবং এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহে কৃষক, শ্রমিক এবং মহিলাদেরকে যথাসম্ভব বিশেষ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেওয়া হবে৷" এ অনুচ্ছেদে কৃষক, শ্রমিক এবং নারীদের সফল অংশগ্রহনের কথা বলা হয়েছে৷
১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে৷"এখানে জনগনের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে৷
৫৯(১) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, "আইন মোতাবেক নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে৷"
অনুচ্ছেদ ৫৯(২)-তে বলা হয়েছে, "এই সংবিধান ও অন্য কোন আইন সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করবেন এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লেখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করবেন এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয় সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে:
(ক) প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারীদের কার্য;
(খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা;
(গ) জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন৷
উপরোক্ত অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সকল স্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির এবং এ সকল প্রতিষ্ঠানকে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে৷
৬০ নং অনুচ্ছেদে "স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ এবং নিজস্ব তহবিল রক্ষনাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে৷" এ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষমতা প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে৷
সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান শক্তিশালী স্থানীয় সরকার কাঠামোর জন্য নির্দিষ্ট এলাকার স্থানীয় প্রতিনিধিদের সমম্বয়ে গঠিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কাঠামো নির্ণয় করে দিয়েছে৷ যেখানে কৃষক, শ্রমিক ও নারী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হবে৷ স্থানীয় সরকারের ক্ষমতাও এইভাবে নির্নয় করা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি প্রশাসনিক কাঠামোর ক্ষমতা বিধিমোতাবেক স্থানীয় সরকার কাঠামোর কাছে ন্যস্ত থাকবে৷ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রশাসনিক, বিচারবিভাগীয়, আর্থিক, উন্নয়নমূলক ভূমিকা প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে৷ এই স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে শুধু সুশাসনে অবদান রাখবে না বরং উত্তম সেবা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসূচিসমূহের ব্যবস্থাপনায় অধিক সাফল্যের নিশ্চয়তা বিধান করবে৷ এর মাধ্যমে জনগন দেখতে পাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের ভাগ্য উন্নয়নে কতটুকু কাজ করছে৷
শহর বা পৌর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা
পৌরসভার স্থাপন ও গঠন প্রকৃতি |
সিটি কর্পোরেশনের গঠন প্রকৃতি |
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় পৌরসভা স্থানীয়ভাবে পৌরবাসীর আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবত্ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশের পৌরসভাগুলো ১৯৭৭ সালের পৌরসভা অধ্যাদেশ কর্তৃক গঠিত ও চালিত হয়৷ বর্তমান আলোচনায় সেই আইনের ধারা উপধারা ভিত্তিক জটিল আলোচনায় যাওয়া হয় নি৷ বরং সেই আইনের আলোকে একটি সাধারণ আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পৌরসভার চেহেরা চরিত্র এবং কার্যক্রম বুঝার জন্যে যথেষ্ট হবে বলে আশা করা যায়৷ তারপরেও পাঠকের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা আলোচনার শেষাংশে পৌরসভা সংক্রান্ত মূল আইন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিধিমালা সংযুক্ত করা হলো৷
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস